ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ নৌবন্দর থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত চার লেন সড়কের কাজ চলছে। ঈদযাত্রায় এই সড়কপথে যাত্রীদের ভোগান্তির আশঙ্কা রয়েছে।
ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের কথাই ধরা যাক। এই পথে চার লেনে উন্নীত করার কাজ চলছে। নারায়ণগঞ্জ থেকে নরসিংদী পর্যন্ত হাটবাজারের জন্য এমনিতেই সবসময় চাপ থাকে। এখন কাজের জন্য কোথাও রাস্তা সরু হয়ে গেছে, কোথাও খানাখন্দ তৈরি হয়েছে। ধুলোর উড়াউড়ি তো আছেই—গাড়ির জানালা খুলে বসা যায় না। এই রাস্তা দিয়ে ঢাকা, সিলেট আর চট্টগ্রাম বিভাগের ৯টি জেলার মানুষ যাতায়াত করেন। লাখো মানুষের কথা চিন্তা করলে বোঝা যায়, এখানে একটু গাফিলতি হলেই বিপদ।
এদিকে, টাঙ্গাইল-রংপুর পথে ছয় বছর ধরে চার লেনের কাজ চলছে, কিন্তু শেষের দেখা নেই। যমুনা সেতুর আগের অংশে এখনো কাজ চলমান। ঈদের শেষ চার দিনে এই সেতু দিয়ে গড়ে প্রতিদিন ৫০ হাজারের মতো গাড়ি চলে। এই পথে ঢাকা, রাজশাহী, রংপুর আর খুলনা বিভাগের ২১টি জেলার মানুষ যাতায়াত করেন। গাড়ির চাপ বাড়লে আর যদি কোনো গাড়ি রাস্তায় বিকল হয়ে যায়, তাহলে যানজটের দৃশ্যটা কল্পনা করাই যায়।
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের অবস্থাও খুব একটা ভালো না। রাস্তার দু’পাশে অবৈধ দখলদারদের জন্য অনেক জায়গায় রাস্তা সংকুচিত হয়ে গেছে। গাজীপুরে পোশাক কারখানা ছুটি হলে লাখো শ্রমিক একসঙ্গে রাস্তায় নামেন, ফলে চাপ আরো বেড়ে যায়। ব্যবস্থাপনায় গড়িমসি হলে যেকোনো মুহূর্তে যানজটে আটকে যাওয়ার ভয় আছে।
এবার ঈদযাত্রায় নতুন করে মাথাব্যথা বাড়িয়েছে মহাসড়কে ডাকাতির ঘটনা। পুলিশের হিসাবে, গত ফেব্রুয়ারিতে ৭৪টা ডাকাতির মামলা হয়েছে, জানুয়ারিতে ছিল ৭১টা। গত বছরের প্রথম দু’মাসে এটা ছিল ৬২টা। হাইওয়ে পুলিশ ১,৪০০ জনের একটা তালিকা তৈরি করেছে, যারা এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে। রাতের বেলা বাড়ি ফেরার পথে ডাকাতির ভয়ে অনেকেই টেনশনে আছেন।
সরকার অবশ্য হাত গুটিয়ে বসে নেই। সড়ক পরিবহন ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বাস, রেল আর লঞ্চ টার্মিনালে সিসিটিভি বসাচ্ছে। পুলিশ আর সংশ্লিষ্টরা এর মাধ্যমে সবকিছু নজরে রাখবে। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে পুলিশের উপস্থিতি বাড়ানোর কথাও বলা হয়েছে। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান জানিয়েছেন, তিনি নিজে মন্ত্রণালয় আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে মিলে ঈদযাত্রার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তদারকি করবেন। কোনো অভিযোগ বা বিশৃঙ্খলা চোখে পড়লেই তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ঢাকা থেকে ঈদে বাড়ি যান ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ। পরিবহন সেক্টরের লোকজন বলছেন, যাত্রার শুরু থেকেই দুর্ভোগের শুরু। ঈদের শেষ চার দিনে এত মানুষের জন্য ট্রেন, বাস, লঞ্চে জায়গা থাকে না। টিকিট জোগাড় করা আর যাত্রা শুরু করাই একটা যুদ্ধ। তারপর রেলস্টেশন, বাস টার্মিনাল, লঞ্চঘাটে ভিড়ের ভোগান্তি, বাড়তি ভাড়ার চাপ—সব মিলিয়ে মাথা গরম। ট্রেনে মাত্র ৩৫ হাজার মানুষ যেতে পারে, তাই মূল চাপটা পড়ে সড়কের ওপর।
বুয়েটের অধ্যাপক মো. হাদীউজ্জামান ২০২২ সালে একটা সমীক্ষা করেছিলেন। তাতে দেখা গেছে, ঈদের আগের চার দিনে ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ ঢাকা ছাড়েন। প্রতিদিন গড়ে ৩০ লাখ লোক বাড়ি যান। কিন্তু গণপরিবহনে দিনে মাত্র ২২ লাখ মানুষ পরিবহন সম্ভব। বাকি ৮ লাখ ট্রাক, অটোরিকশার মতো অপ্রচলিত যানে গাদাগাদি করে যান। কেউ কেউ মোটরসাইকেলে, কেউ ব্যক্তিগত গাড়িতে যান। হাদীউজ্জামান বলছেন, তিন বছরে অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। বরং মানুষের সংখ্যা আরো বেড়েছে। তিনি বলেন, ঈদের সময় মহাসড়কের উন্নয়ন কাজ বন্ধ রাখা দরকার। ঠিকাদাররা যেন রাস্তায় নির্মাণসামগ্রী না ফেলে, তার ওপর নজর রাখতে হবে। সরু রাস্তায় ওভারটেকিং বন্ধ করতে পারলে অনেক সমস্যা কমবে।
তো, এবারের ঈদযাত্রা নিয়ে আশা-আশঙ্কা দুটোই আছে। সরকার চেষ্টা করছে, কিন্তু রাস্তার অবস্থা আর ব্যবস্থাপনার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। সবার কামনা একটাই—যাত্রাটা যেন স্বস্তির হয়, ভোগান্তি যেন না ডেকে আনে।
0 মন্তব্যসমূহ